প্রচলিত তাবলীগ জামাত সম্পর্কে কয়েকটি জিজ্ঞাসা
প্রশ্ন : আমাদের গ্রামে একটি নতুন জামে মসজিদ হয়েছে। কিছুদিন পূর্বে স্থানীয় তাবলীগী মুরব্বিদের পরামর্শে একটি জামাত ওই নতুন মসজিদে আসে। আসার পর তারা মসজিদে অবস্থান করলে মসজিদের ইমাম তাদেরকে অন্যত্র চলে যেতে বলেন এবং কয়েকজন মুসল্লিও তাদের ব্যাপারে আপত্তি তোলেন। ইমাম সাহেব বলেন, আমাদের মহল্লায় তাবলীগ আসার প্রয়োজন নেই, কারণ মহল্লাবাসী সবাই মুসলমান। আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তো কাফেরদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন। আবার অন্য এক আলেম বলেন, তারা আসতে পারে; কিন্তু রাত্রে মসজিদে থাকতে পারবে না। তিনি তাবলীগ জায়েয কি না এ ব্যাপারে মসজিদ কমিটির সাথে কথা বলেন। এবং বলেন যে উক্ত গ্রামের একটি সরকারি আলীয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মরহুম বলেছেন, এই গ্রামে যেন তাবলীগ না আসতে পারে। তাঁর কথা অনেকেই বিনা ব্যাখ্যায় গ্রহণ করে নিয়েছেন। আর মসজিদের ইমাম সাহেবও এ কথা সবাইকে বলেছেন যে তাবলীগ আসার ফলে সৃষ্টি হওয়া এই বিবাদের কারণে মহল্লাবাসী বিভক্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন। মহল্লাবাসীর মধ্যে অনেকেই তাবলীগ ও মসজিদে তাবলীগ জামাতের রাত্রি যাপনের ব্যাপারে বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন। মোটকথা, এখানে একটি ঘোলাটে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
সুতরাং আলোচ্য ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নের উদয় হয়েছে। তাই আমরা এই সমস্যা হতে পরিত্রাণ পেতে মুফতী সাহেবের শরণাপন্ন হয়েছি। আমরা তাবলীগ জামাত সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা ও নিম্নবর্ণিত প্রশ্নগুলোর দলিলভিত্তিক সুষ্ঠু সমাধান চাই।
১. তাবলীগ জামাত কী? তাদের ইতিহাস অর্থাৎ কিসের ওপর ভিত্তি করে এর প্রবর্তন? বিস্তারিত জানতে চাই।
২. তাবলীগ জামাতের কাজ কী? তাদের কাজের সাথে নবীজির ধর্মপ্রচার কাজের কোনো মিল আছে কি না?
৩. ইসলামের শুরু যুগে, অর্থাৎ নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম), সাহাবী, তাবেঈদের যুগে প্রচলিত তাবলীগ ছিল না। সুতরাং নতুন পদ্ধতি শরীয়তে আবিষ্কারের ফলে বিদ’আত বলে গণ্য হবে কি না?
৪. তাবলীগের লোকজন দ্বীন প্রচার করতে বাড়িঘর ছেড়ে চলে আসেন, তাঁদের বিবি-বাচ্চাকে দেখবে কে? তা কি শরীয়তে বাড়াবাড়ি নয়?
৫. তাবলীগের লোকজন রাত্রে মসজিদে থাকেন। অথচ মসজিদে অবস্থান করা জায়েয নেই। তাঁরা এ ক্ষেত্রে কোন পন্থা অবলম্বন করেন?
৬. তাবলীগ জামাত মসজিদে প্রবেশের ব্যাপারে কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে কি না? থাকলে তা কী কী?
৭. তাবলীগ জামাত সম্পর্কে ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গি কী? জায়েয, সুন্নাত, ফরয, মুস্তাহাব, মাকরূহ কোনটির আওতায় পড়ে?
উত্তর : ১. আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ওপর অর্পিত দায়িত্বসমূহের মূল বিষয় ছিল তাবলীগ তথা দ্বীনের প্রচার-প্রসার। এ মর্মে ইরশাদ হচ্ছে, হে রাসূল! আপনার প্রভুর পক্ষ থেকে আপনার ওপর যা কিছু অবতীর্ণ হয়েছে, আপনি তা পৌঁছিয়ে দিন। (মায়েদা : ৬৮)
এ ক্ষেত্রে কখনো রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মানুষের কাছে গিয়ে দ্বীনের কথা বলতেন, আবার কখনো লোকজন তাঁর কাছে এসে দ্বীনের কথা শুনতেন। দ্বীন প্রচারের ধারাবাহিকতায় এ দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে উম্মতের ওপর। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেন, আমার পক্ষ থেকে একটি বাণী হলেও পৌঁছিয়ে দাও। (বুখারী শরীফ, ৩৪৬১)
বিদায় হজের ভাষণে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উপস্থিত সাহাবায়ে কেরামকে বলেছেন, আমার এ কথাগুলো অনুপস্থিত লোকদেরকে পৌঁছিয়ে দেবে। (বুখারী শরীফ : ২৯)
সাহাবায়ে কেরাম রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নির্দেশে হেদায়েতের বাণী পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েন এবং দ্বীনের প্রতিটি বিষয়ে তাবলীগ করেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও সাহাবায়ে কেরাম কর্তৃক দ্বীনের দাওয়াত সর্বত্র পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কখনো কাউকে নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে যে গাশত করে অমুক বিধান সবার নিকট প্রচার করে দাও। (বুখারী শরীফ, খণ্ড ২, পৃ. ৮৯)
কখনো লোকজন ডেকে নিয়ে জমা করে কোনো বিধান শুনিয়ে দেওয়া হয়েছে। (বুখারী শরীফ, ৪৭৭০)
কখনো হজের সময় গ্রামে লোকজন পাঠিয়ে বলা হয়েছে যে সকলের নিকট এই বিধান পৌঁছে দাও। (বুখারী : ২/৬৭১)
এ ছাড়া সকল সাহাবায়ে কেরামকে কালেমায়ে তাইয়্যিবা পড়ে নিজেদের ঈমান নবায়ন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। (মুসনাদে আহমদ, খণ্ড : ২, পৃ. ৩৬৯)
(১৯/৩/৭৯৪৮)
২. তাবলীগ জামাতের মৌলিক কাজ হলো, নিজেরা দ্বীন শেখা, অন্যদেরকে দ্বীন শেখানো এবং পরস্পরের মাঝে ঈমানী চেতনা সৃষ্টিকরত দ্বীনের তলব জাগিয়ে তোলা। যেহেতু রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও সাহাবায়ে কেরামের আদর্শকে সামনে রেখেই তাবলীগ জামাতের কর্ম-পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও সাহাবায়ে কেরামের ধর্ম প্রচারের পদ্ধতির সাথে তাদের কর্ম-পদ্ধতির পরিপূর্ণ মিল রয়েছে।
৩. কোনো ভিত্তিহীন নবাবিষ্কৃত বিষয় শরয়ী বিধান হিসেবে মানাকে বিদ’আত বলে গণ্য করা হয়। যেহেতু তাবলীগের মেহনত ও কাজের বিভিন্ন পদ্ধতি ভিত্তিহীন নয়, আবার এ কাজের নব পদ্ধতিগুলো শরয়ী বিধান হিসেবেও মানা হয় না। বরং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মানুষের উপকারার্থে কিছু মৌলিক নীতি হিসেবে এগুলো অনুসরণ করা হয়। তাই এ নব পদ্ধতিগুলো বিদ’আতের অন্তর্ভুক্ত হবে না। বরং ভালো কাজের সহায়ক হিসেবে তা প্রশংসনীয়।
৪. বিবি-বাচ্চার হক্ব পরিপূর্ণ আদায়করত তাবলীগ জামাতে বের হওয়া এবং তাবলীগে সময় লাগানো শরীয়ত পরিপন্থী নয়।
৫. শরয়ী দৃষ্টিকোণে মুসাফির, ই’তেকাফকারী, ইলম ও দ্বীনের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের জন্য প্রয়োজনে মসজিদে অবস্থান করা, মসজিদ খাওয়া-দাওয়া ও ঘুমানো জায়েয ও বৈধ বলে বিবেচিত। যেহেতু তাবলীগ জামাতের লোকেরা দ্বীনের কাজে নিয়োজিত, আর সাধারণত তাঁরা মুসাফির হয়ে থাকেন এবং ই’তেকাফের নিয়্যাতেই মসজিদে অবস্থান করে থাকেন, তাই তাঁদের জন্যও মসজিদে অবস্থান, রাত্রি যাপন ও খাওয়া-দাওয়া জায়েয হওয়ার ক্ষেত্রে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। তবে মসজিদে অবস্থান, খাওয়া-দাওয়া ও ঘুমানোর ক্ষেত্রে অবশ্যই পরিপূর্ণভাবে মসজিদের আদব-এহতেরাম বজায় রাখতে হবে।
৬. মসজিদের পরিপূর্ণ আদব-এহতেরাম রক্ষাকরত তাবলীগ জামাতের মসজিদে প্রবেশের ব্যাপারে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। বরং যেহেতু তাঁরা মসজিদে দ্বীনি কাজে নিয়োজিত থাকেন, তাই কারো জন্য তাঁদের মসজিদে প্রবেশের ব্যাপারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা জায়েয হবে না।
۔৭. তাবলীগ তথা দ্বীন প্রচারের মেহনত আল্লাহ তা’আলা ও রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পক্ষ থেকে আমাদের ওপর অর্পিত একটি মহান দায়িত্ব। শরয়ী বিধান হিসেবে মৌলিকভাবে তাবলীগ ফরযে কেফায়া (অর্থাৎ এলাকার কিছু লোক এ মেহনতের সাথে জড়িত থাকলে বাকিরা দায়িত্বমুক্ত থাকবে) তবে অবস্থার প্রেক্ষাপটে এর বিধানগত অবস্থা পরিবর্তন হতে পারে এবং এ বিধানটি বিভিন্ন পদ্ধতিতে পালন করা যায়।
Tag:তাবলীগ